আমার ফুফুত ভাই সেলিম রহমান কানাডা প্রবাসী। পেষায় তিনি ফার্মাসিস্ট। প্রায়ই তাঁর সাথে ফোনে কথা হয়। তবে সে সব ঔষধ বিষয়ক নয় এমনকি পারিবারিকও নয়। এই করোনা কালীন সময়ে দু/একটা প্রশ্ন আমি তাঁকে টিকা নিয়ে করেছি কিন্তু তা খুবই নগণ্য। তিনি বঙ্গবন্ধুর একজন একনিষ্ঠ ভক্ত। তাঁর বিষয়ে কোন অসতর্কতা তিনি সহ্য করতে পারেন না। আর অবহেলা হলে তো ক্ষোভে ফেটে পড়েন। দীর্ঘদিন তিনি প্রবাসী কিন্তু খবরের কাগজ বা পত্রিকা যা পড়েন সবই বাংলাদেশের। অনেক সময় তাঁর সাথে কথা বলতে যেয়ে লজ্জায় পড়ি যে, আমি দেশের সেই খবরগুলো জানিনা। তিনি খুবই রাজনীতি সচেতন মানুষ। তাঁর সাথে আমার কথাও হয় তাই বঙ্গবন্ধু দেশ ও রাজনীতি নিয়ে বেশী।

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কথা প্রসঙ্গে তিনি একদিন জানালেন। লীপু(আমার ডাক নাম) তুই কী জানিস বঙ্গবন্ধু একবার হরিনারায়নপুরে একটা জনসভা করেছিলেন? তৎকালীন কুষ্টিয়ার এই স্থানটা এখন ঝিনাইদহ জেলার অন্তর্গত। যা তাদের বাড়ীর খুব কাছাকাছি। সেই জনসভায় তার যাওয়ার সুযোগ হয়নি, তবে তাঁর এলাকার এক বড় ভাই শেখ আফজাল হোসেন গিয়েছিলেন। সেলিম রহমান বিদ্যালয়ে তাঁর এক বছরের কনিষ্ঠ হলেও দুজনের মধ্যে খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল। শেখ আফজাল ছোট বেলা থেকেই ভাল ছবি আঁকতেন। সেই জনসভায় তিনি নাকি বঙ্গবন্ধুর একটা ছবি এঁকেছিলেন। একথা জানার পর আমি খুব আগ্রহী হয়ে উঠি। তখন আমি তাঁকে বলি মিয়াভাই (সেলিম রহমানকে আমরা ‘মিয়া ভাই’ ডাকি) আফজাল ভাইয়ের সাথে সরাসরি কথা বলার একটু ব্যবস্থা করা যাবে। তিনি জানালেন, “আফজাল ভাই খুব মিশুক এবং নিরহঙ্কার মানুষ সমস্যা হবে না। আর আমার সাথে তাঁর খুব ভাল সম্পর্ক ছিল পরিচয় দিলে চিনবে। তাছাড়া আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসীতে পড়ি তিনিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের ছাত্র ছিলেন, মাঝে মাঝে দেখা হয়েছে। তাঁর সাথে অনেক আড্ডা দিয়েছি। আর এখন তিনি চারুকলার একজন অধ্যাপক।”
মিয়াভাই আমাকে শিল্পীর টেলিফোন যোগাড় করে দেবার আগেই আমি তাঁর ফোন নাম্বার যোগাড় করে ফেললাম। নাম্বারটা আমাকে দিলেন তাঁর মেজ ভাই ব্যাংকার হাসান রহমান। শিল্পী আফজাল হোসেনের এক ভাই তার বন্ধু বিধায়, তিনি আমাকে দ্রুত নাম্বারটা যোগাড় করে দিতে পেরেছিলেন। নাম্বারটা পাবার পর দ্রুততম সময়ে শিল্পী শেখ আফজাল হোসেনকে ফোন করলাম। দুই বার ফোন করলাম কেউ ফোন ধরলেন না। তারপর এক সময় তিনি নিজেই আমাকে ফোন করে বসলেন। আমি ফোন ধরে তাঁকে বললাম, আপনি ফোন রাখেন, “আমিই আপনাকে ফোন করছি।” তারপর ফোন করে পরিচয় দিলাম যে, আমি সেলিম রহমানের মামাত ভাই।” তিনি বললেন, “ও সেলিম ওর মুখে একটা তিল ছিল না?” সম্মতি জানিয়ে বললাম ঠিক ধরেছেন। শিল্পীকে দেখলাম তাঁর কথার মধ্যে ওই এলাকার আঞ্চলিক টান ধরে রেখেছেন। তাঁর সাথে কথা বলে খুব ভাল লাগছিল, আমি বেশ শিহরিত হয়েছিলাম সেদিন।
৬ দফা দাবি উত্থাপনের পর বঙ্গবন্ধু দাবিগুলোর স্বপক্ষে জনগণকে সচেতন ও সোচ্চার হতে সারা দেশ চষে বেড়িয়েছেন। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৬৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে তিনি কুষ্টিয়ার হরিনারায়ণপুরে একটি জনসভায় বক্তৃতা করেন। সেদিন শিল্পী আফজালের চাচা, মামা ও বড় ভাই সহ গ্রামের নেতৃস্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মীরা তাঁকে নিয়ে যেয়ে মঞ্চের এক কোণে বসিয়ে দেন। সেই সময় চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র আফজাল হোসেন। তখন কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই নিজে নিজে ছবি আঁকা রপ্ত করেছিলেন। সেদিন মঞ্চে উঠে বঙ্গবন্ধু কিছুক্ষণ পর ভাষণ দিতে শুরু করেন। আর একপাশ থেকে বঙ্গবন্ধুকে দেখে দেখে আফজাল হোসেন ছবি আঁকা শুরু করেন। তিনি সেদিন প্রস্তুত হয়েই গিয়েছিলেন জনসভায় খাতা পেন্সিল নিয়ে। ১০-১২ মিনিট পরেই বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণ শেষ করে দেখেন কী করছে ক্ষুদে শিল্পী। তারপর চেয়ার থেকে উঠে এসে তাকে জিজ্ঞাসা করেন, “কী আঁকলে?” তখন তিনি কাঁচা হাতে আঁকা বঙ্গবন্ধুর ছবিটা উপস্থাপন করেন। তিনি খুব খুশি হয়ে পকেট থেকে দুটি ১০ টাকার নোট বের করে শিল্পীকে উপহার দিয়ে বলেন, ‘চকলেট খেয়ো।’ তিনি ক্ষুদে শিল্পীর গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে অনেক আদর করে দেন।
এখন চিত্রশিল্পী শেখ আফজাল হোসেন একজন অধ্যাপকই শুধু নন তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতিও পেয়েছেন। পড়াশুনা করেছেন জাপানে সেখানে পুরষ্কারও পেয়েছেন। কিন্তু তাঁর সেসব পরিচয় নিজ গ্রামে গৌন থেকে গেছে। সেই ১৯৬৯ সালে তিনি বালক বয়সে বঙ্গবন্ধুর ছবি এঁকে পরিচিতির সর্ব শিখরে উঠেছিলেন সেটাই মুখ্য হয়ে আছে আজ পর্যন্ত তাঁর নিজ এলাকায়। চলেন সে কথা শুনি তাঁর মুখেইঃ
লেখকঃ আমার ভাই সেলিম রহমানের কাছ থেকে শুনেছি হরিনারায়ণপুরের সেই জনসভায় আপনি দূর থেকে দেখে বঙ্গবন্ধুকে এঁকেছিলেন। তারপর ছবিটা উঁচু করে ধরলে তাঁর নজরে আসে এবং তিনি আপনাকে মঞ্চে ডেকেছিলেন। তারপর তিনি উপস্থিত জনগণকে আপনার আঁকা ছবিটা দেখান। আর আপনার বগলের নিচে হাত দিয়ে উঁচু করে ধরে সবাইকে দেখিয়েছিলেন। ঘটনাটা কী এমনই ছিল?
শেখ আফজাল হোসেনঃ ঠিক দূরে বসে না। আমাকে মঞ্চের উপর বসিয়ে দিয়েছিল। মঞ্চের ওপর বসেই, বঙ্গবন্ধু যখন বক্তব্য দিচ্ছিলেন তখন আমি এঁকেছিলাম তাঁকে। না তিনি আমাকে উঁচু করে ধরেননি। আমার কাছে জানতে চাইলেন কোন ক্লাসে পড়ি। তারপরে বললেন মেট্রিক পাস করে আর্ট কলেজে ভর্তি হতে হয়। জয়নুল আবেদীন আমার বন্ধু আমি তাঁকে বলে দেবো তোমাকে আর্ট কলেজে ভর্তি করিয়ে নেবে। তুমি মেট্রিক পাশ করে আমার কাছে আসবে, আমি তোমাকে ভর্তি করিয়ে দেবো।
লেখকঃ আপনাকে মঞ্চে বসিয়ে দিয়েছিলেন কারা কিভাবে আপনি সুযোগটা পেলেন?
শেখ আফজালঃ তুমি তো যোগীপাড়া গ্রামটা চেন, আমার বাড়ি হল যোগীপাড়া শেরপুর। সেলিমের বাড়ি ছিল বোয়ালিয়া। বসন্তপুর, শ্রীরামপুর, শেরপুর, মথুরাপুর, মদনডাঙ্গা হাই স্কুল ওর কাছাকাছি। আমরা সবাই একই স্কুলে পড়তাম। এলাকার সিনিয়র বড় ভাই যারা কেউ মাধ্যমিকে পড়তো বা কলেজে পড়তো তারা আমাকে নিয়ে গিয়েছিল। তার মধ্যে ছিলেন আমার এক মামা নাম রোহিত, রুস্তম ভাই। তারা আমাকে স্টেজে বসিয়ে দিয়েছিল। তখন আমি বঙ্গবন্ধুকে সামনে বসে এঁকেছিলাম।
লেখকঃ আপনি সেদিন যে ছবিটা এঁকেছিলেন সেই ছবিটা কী এখনো আছে, না সেটা নষ্ট হয়ে গেছে?
শেখ আফজালঃ না না (একটু হেঁসে) ও ছবিটা তো, আমার বাড়ি রাজাকাররা এসে তছনছ করে, ভেঙে ফেলে। তারপর আমার বড় ভাই ছিল মুক্তিযোদ্ধা। তখন সে ক্লাস নাইনে পড়তো মুক্তিযোদ্ধা ছিল, আমার আব্বাও মুক্তিযোদ্ধাদের প্লান প্রোগ্রাম করে দিতেন। এগুলোর কারণে ওই রাজাকাররা আমাদের বাড়িতে হামলা করে। আমাদের বাড়িতে আর রুস্তম ভাইয়ের বাড়িতে একই দিনে হামলা করে।
লেখকঃ আপনার বাড়িতে কি আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল?
শেখ আফজাল হোসেনঃ না আগুন ধরায়নি, কিন্তু ভেঙে-চুরে ফেলেছিল। আমার ওই ছবিটা ছিল। ছবিটা ভেঙে নষ্ট করে। তারপর আর ছবিটা পাইনি। আমি এটা-ওটা অনেক কিছু বানাতাম। আমার ঘুড়িসহ অন্যান্য জিনিস গুলো সব নষ্ট করে দিয়েছিল। পাড়িয়ে-দলিয়ে একেবারে শেষ করে দিয়েছিল।
লেখকঃ এটা কী আক্রোশে ক্ষোভে যে, ‘আপনি স্বাধীনতার পক্ষের মানুষ, এই কারণেই কী তারা এটা করেছিল?’
শেখ আফজালঃ হ্যাঁ-হ্যাঁ তাছাড়া ওই এলাকায় আমি বঙ্গবন্ধুর ছবি এঁকেছিলাম এটা সবাই জানে। একেবারে রাজাকার থেকে শুরু করে সবাই।
লেখকঃ সেই সময় আপনি এরকম একজন নেতার কাছ থেকে টাকা পাচ্ছেন, বঙ্গবন্ধু আপনাকে চকলেট খাবার জন্য টাকা দিয়েছেন। সেটাতো সবাই জানতো বা জানার কথা, না জানার কোন কারণ ছিল না যেহেতু ঘটনাটা একটা জনসভায় ঘটেছিল?
শেখ আফজালঃ এখন পর্যন্ত ওই ঘটনা আমার এলাকার সবাই জানে। আমিতো এখন চারুকলার অধ্যাপক। চারুকলা মানে ঢাকা ইউনিভার্সিটির ফ্যাকাল্টি অফ ফাইন আর্টসের আমি একজন অধ্যাপক। এবং পেইন্টিং ডিপার্টমেন্টের ‘হেড অফ দা ডিপার্টমেন্ট’। তারপরও অনেক আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছি। জাপানে পড়াশোনা করেছি, জাপানি পুরস্কার পেয়েছি। আমার এলাকায় কিন্তু অত-শত কেউ জানে না। এখনও জানে যে আমি বঙ্গবন্ধুর ছবি এঁকেছিলাম। সেই হিসেবেই আমাকে জানে। শেখপাড়া মাঝে মাঝে যাই ওখানে গেলেও, এইতো গত সপ্তাহে গিয়েছিলাম। সেই আগের মতই সবাই জানে বঙ্গবন্ধুর ছবি আঁকা সেই শিল্পী। (একটু হেসে) ওই পরিচয়টাই এখনও প্রধান।
লেখকঃ এই ঘটনাটা আপনাকে কতটা অনুপ্রাণিত করেছিল? ধরে নিই বিশ টাকা, এটা কোন ব্যাপার না, এটা বড় কিছু না। কিন্তু তাঁর মত একজন মানুষ, বড় একজন নেতা আপনার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছেন এই স্নেহ পুরস্কার, এই ব্যাপারটা আপনাকে কিভাবে অনুপ্রাণিত করেছে পরবর্তী জীবনে?
শেখ আফজালঃ এটা তো সাংঘাতিক ব্যাপার, এটা তো আমার জন্য বিরাট একটা আশীর্বাদ। বঙ্গবন্ধুকে এঁকেই কিন্তু আমার ছবি আঁকা শুরু। প্রধানত আমি কিভাবে চারুকলায় মানে আর্ট কলেজে ভর্তি হব, এটা কিন্তু আমার মাথার মধ্যে তখন থেকে তৈরি হয়েছিল। তারপরে আমার পরিবার, আমার আশেপাশের যত লোক এগুলো দেখেছিল, বঙ্গবন্ধুর উপরে তাদের সাংঘাতিক শ্রদ্ধা-ভক্তি চলে আসে। যার জন্য আমাদের ওই এলাকা এখন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর সাংঘাতিক ভক্ত এবং আওয়ামী লীগের ভক্ত। আমার ফ্যামিলির অনেকে তো অনেকভাবে অত্যাচারিত হয়েছে কিন্তু তারা কখনো পিছপা হয়নি। তারা বঙ্গবন্ধুর ভক্ত আওয়ামী লীগের ভক্ত ও শেখ হাসিনার ভক্ত। বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি হয়নি সে অবস্থান থেকে।
এক অনন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চেনালেন শিল্পী শেখ আফজাল হোসেন

লেখকঃ আরেকটা ঘটনা আমি শুনেছি আমাদের প্রধানমন্ত্রী ১৯৯৬ সালে প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর বিদেশে শিল্পীদের একটি প্রতিনিধি দল গিয়েছিল। এসময় নাকি তিনি বলেছিলেন, “আপনার নামটা যেন এই দলে থাকে।” কিন্তু যখন তালিকা তৈরি করা হয় সেই তালিকায় আপনার নাম না দেখে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন …………
শেখ আফজালঃ না তার কারণ কি উনি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর যখন বাংলাদেশে আসে ৮৪,৮৫ না ৮৩তে আসে বোধহয়। তখন তিনি আসার পরে, আমার এক জুনিয়র সে রাজনীতি করতো…
লেখকঃ উনি দেশে আসেন ৮১ সালে।
শেখ আফজালঃ রাইট ৮১ সালে, তো আমি ৮৪ কি ৮৫ সালে হবে আমাকে নিয়ে যাওয়া হল যে, বঙ্গবন্ধুর সাথে ৩২ নাম্বারে যারা মারা গিয়েছিলেন তাদের পোট্রেট করার জন্য। তখন আমি শেখ হাসিনাকে, তখন তো তিনি প্রাইম মিনিস্টার না। তখন নেত্রীকে আমি বলেছিলাম ঘটনাটা(মঞ্চে বসে বঙ্গবন্ধুর ছবি আঁকার ঘটনাটা)। উনি একদম আবেগে আপ্লুত হয়ে গিয়েছিলেন। তারপর আমাকে বলেন যে, “তুমি যখন ওই সময়ে এঁকেছিলে, একটা কাজ করো আমার এই বাড়িতে ১৫ই আগস্ট যারা মারা যায় তাদের টোটাল ছবিটা তোমার আঁকতে হবে।” আমি বলি, “ঠিক আছে, আমি এঁকে দেব।” তখন তো আমি জাপান যাবার জন্য, স্কলারশিপের চেষ্টা করছিলাম এবং পেয়েও যায়। উনি(শেখ হাসিনা) আমাকে বললেন, “তুমি জাপান যাবার আগে আমাকে এটা কমপ্লিট করে দেবে।” আমি অবশ্য ওগুলো কমপ্লিট করে তারপর গেছি। জাপান থেকে পড়ে আসার পরে আমি এখানে একটা জাতীয় পুরস্কার পেলাম। শিল্পকলা একাডেমীর ব্যবস্থাপনায় একটা জাতীয় প্রদর্শনী হয়েছিল, সেখানে আমি পুরস্কার পেয়েছিলাম। তখন তিনি মাত্র প্রাইম মিনিস্টার হয়েছেন এবং ওই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেছিলেন। আমি যখন পুরস্কার পেয়েছি তখন তিনি সাংঘাতিক খুশি হয়েছিলেন। এবং তখন ঘোষণা করলেন যে, “শেখ আফজালের যে দুটো ছবি আছে, ও দুটো ছবি আমি কিনে নিলাম।” প্রদর্শনী শেষ হবার পর তাঁকে ছবি দুটো পাঠিয়ে দেওয়া হল। এরপর বোধহয় ইন্ডিয়াতে একটা বুক ফেয়ারের আয়োজন হয়েছিল। তখন একটা দল ইন্ডিয়াতে যাওয়ার কথা ছিল। যে দলটা যাবে ইন্ডিয়াতে তা আমি জানতাম কারা সব যাবে। সব সিনিয়র, জুনিয়র কেউ ছিলনা। মোটামুটি সিনিয়র থেকে আমাদের একটু আগে পর্যন্ত যারা ছিল। তবে ওই তালিকাটা যখন প্রধান্মন্ত্রীর কাছে গেছে তখন মাত্র একদিন সময় হাতে। কিন্তু এরমধ্যে ভিসা অমুক-তমুক, এটা-ওটা কিছুই নেই আমার কাছে। আমার শুধু পাসপোর্ট আছে।
হঠাৎ করে শিল্পকলা একাডেমী থেকে আমাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। তখন সেখান থেকে বের হচ্ছিলেন সুবীর চৌধুরী, তিনি আমাকে খুঁজে পেলেন। আমাকে কোন কিছু না জানিয়ে শুধু বললেন যে, “আফজাল তোমার পাসপোর্টটা এক্ষুনি নিয়ে আসো, আমার খুব বিপদ।” আমি বললাম, “কিসের বিপদ?” তিনি বললেন, “আসো তুমি আগে তারপর তোমাকে বলছি।” আমি পাসপোর্ট নিয়ে গেলাম উনি বললেন, “আমার চাকরি চলে যাবে তুমি তাড়াতাড়ি পাসপোর্ট দাও।” আমি তো অবাক পাসপোর্ট নিয়ে তিনি কী করবেন। তারপর তিনি জানালেন, “তোমাকে ইন্ডিয়া যেতে হবে, পরশুদিন বিমান, একসাথে যাব আমরা।” আমি জানতে চাইলাম ব্যাপারটা কি? তিনি জানলেন একটা তালিকা করা হয়েছিল শিল্পকলা থেকে, সেখানে তো তুমি ছিলেনা। তখন প্রাইম মিনিস্টার ওটা নিয়ে বলেছেন এর মধ্যে শেখ আফজালকে ইনক্লুড করো। এর মধ্যে তাকে ইনক্লুড করতে হবে। তখন বোধহয় আমাদের হাশেম খান স্যার সিনিয়র মোস্ট ছিলেন। উনি বলেন আফজাল তো অনেক জুনিয়ার। তখন প্রধানমন্ত্রী বলেন ও জুনিয়র হলে কি হবে, ছবিতো ভালো আঁকে। আমি জানিনা কিভাবে হবে কিন্তু ওকে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
তারপর দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে যখন তিনি শপথ নেন তখনও আমার কথা স্মরণ করেন। সেদিন তিনি বলেন, “আমার উপর যে দায়িত্ব বা ভার অর্পিত হল, তা শেখ আফজালের দুটো ছবি আছে আমার কাছে। একটা ছবির নাম হল ‘ওয়েট’। আমার মনে হচ্ছে আমার মাথার উপর এরকম একটা ভার আসছে। সেই ভার বহন করতে আমাকে সাংঘাতিক ভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে।” ঐরকম একটা কথা তিনি সেদিন বলেছিলেন। আমি নিজ কানে শুনিনি, তবে অনেকে আমাকে টেলিফোন করে সে খবর দিয়েছিলেন। এরপর তো প্রধানমন্ত্রীর সাথে অনেকবার আমার দেখা হয়েছে। অনেক ছবির প্রশংসা করেন তিনি।
লেখকঃ আমি আপনাকে একটা ব্যাপারে অবহিত করতে চাই কিছুদিন আগে হাইকোর্টে একটা রিট হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি সংসদের অধিবেশন কক্ষে রাখা নিয়ে। এখন সংসদে একটা ছবি রাখা হয়েছে প্রতিকৃতি না। আপনি চিন্তা করেন সংসদের কর্তা ব্যক্তিরা ছবি আর প্রকৃতির পার্থক্যগুলো বুঝছেন না। কিন্তু তারা অনেকেই উচ্চ শিক্ষিত তাদের এগুলো বোঝা উচিত। অথচ বঙ্গবন্ধু উচ্চ ডিগ্রিধারী ছিলেন না কিন্তু তিনি এই জিনিসগুলো অবলীলায় বুঝতেন। এবং যাকে দিয়ে যে কাজ হবে তাকে দিয়ে সেই কাজগুলো করাতেন।
শেখ আফজালঃ অবলীলায় বুঝতেন এবং আমাদের প্রধানমন্ত্রীর একটা ঘটনা বলি, তিনি যখন প্রথম প্রাইম মিনিস্টার হলেন তারপরের বার তিনি নির্বাচিত হতে পারেননি। তখন তিনি বিরোধী দলীয় নেত্রী। সেই সময় একদিন আমাকে ‘সুধা সদনে’ ডেকে পাঠালেন। ওনার এক বান্ধবী বেবী মওদুদ আমার সাথে তাঁর খুব ভাল সম্পর্ক ছিল। তিনি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন যেহেতু আমি বঙ্গবন্ধুর উপরে অনেক ছবি আঁকি, প্রচ্ছদ করি, ইলাস্ট্রেশন করি আর এটা-ওটা অনেক কিছু করি। আমি এবছরও কিন্তু বঙ্গবন্ধুর উপরে দুই/তিনটা বই ইলাস্ট্রেশন করেছি। তো বেবী আপা আমাকে দিয়ে বিচিত্রার অনেক কাজ করাতেন। কোন প্রচ্ছদ হলে বেবী আপা বলতেন যে, এটা একটু করে দাও।
এরপর একদিন বললেন, আফজাল নেত্রী তোমাকে একটু ডেকে পাঠিয়েছেন। নির্দিষ্ট দিনে আমি বেবী আপা ‘সুধা সদনে’ বসে আছি। নেত্রীর দেখা নেই। অনেকক্ষণ, প্রায় ঘণ্টা দুই বসে থেকে আমি চলে আসি। তারপর আবার গেছি। তিনি বেবী আপাকে আবার বলেন, “তুমি আফজালকে বল আরেকদিন আসতে। সেদিন তিনি সমস্ত প্রোগ্রাম বাদ দিয়ে বসে আছেন আমার জন্য। আমি গেলাম, আমাকে উপরে যেতে বললেন দোতালায়। তখন তিনি বলেন যে, “আফজাল আমি দুঃখিত, এটাতো বোঝোই আমি রাজনীতি করি, এক জায়গায় গেলে সময় ঠিক রাখতে পারিনা, অনেক ক্ষেত্রে। সেদিন সময় মত ফিরতে পারিনি, তুমি চলে গেছো।” তখন আমি বলি, “না না আপা ঠিক আছে কোন অসুবিধা নেই।”
এর আগে একটা ছবি আমি ওনার বাসায় রেখে আসি। সেটা ছিল একটা পেইন্টিং, বঙ্গবন্ধুর ইয়ং বয়সের একটা পেইন্টিং করে দিয়ে এসেছিলাম। তারপরে তিনি আমাকে দেখা করার জন্য বলেছিলেন। প্রথম দিন যেয়ে তো ফিরে আসলাম, দ্বিতীয় দিন যেয়ে আমার সাথে দেখা হল। তখন তিনি বললেন আফজাল তোমার ছবিতে একটা ভুল ছিল। কী ভুল আপা বুঝলাম না কোন জায়গায়? তিনি বললেন যে, “ডানদিকের ব্যাকগ্রাউন্ডে তোমার পোট্রেটের এন্ডিং যে জায়গাটা ওটা একটু হার্ড হয়ে গিয়েছিল। আমি একটু সফট করে দিয়েছি।” আমি, ‘কিভাবে আপা’? তিনি বললেন, “আমার কাছে তো ব্রাশ নেই আমি হাত দিয়ে ডলে ব্যাকগ্রাউন্ডের সাথে মিলিয়ে দিয়েছি।” আমি এটা শুনে থ হয়ে গেলাম। আমি যে ফটোগ্রাফ থেকে পেইন্টিং করেছিলাম তার সাথে মিলিয়ে দেখি আসলেই তাই। এটা সাংঘাতিক ব্যাপার একটা। উনি বললেন, “আমিতো ছবি আঁকা শিখতাম।” সাইফুল ইসলাম নাম করে একজন অ্যামেচার আর্টিস্ট ছিলেন, তার বাড়ি কুষ্টিয়া যার কাছে তিনি ছবি আঁকা শিখতেন। বঙ্গবন্ধুর খুব ভক্ত ছিল সেই সাইফুল ভাই। আপারা(শেখ হাসিনা) যখন ছোট ছিলেন তখন তাদেরকে ছবি আঁকা শেখানো হত।
বঙ্গবন্ধুর যে সেন্স, ছবি আঁকা বা গান-বাজনা এগুলোর উপর তা ধারণাতীত। তার একটা সাংঘাতিক হৃদয়ের সম্পর্ক ছিল সংস্কৃতির সাথে। যেমন জসীম উদ্দিনের সাথে তার সাংঘাতিক দহরম ছিল। কুদরত-ই-খোদার সাথে খুব ভাল বন্ধুত্ব ছিল। তারপর আব্দুল আলীমের তিনি সাংঘাতিক ভক্ত ছিলেন। আব্দুল আলীমকে বাসায় নিয়ে যেয়ে গান গাওয়াতেন। আব্বাস উদ্দিন থেকে শুরু করে আব্দুল আলীম তাদের খুব ভক্ত ছিলেন। বিশেষ করে আব্দুল আলীম তো রেগুলার উনার বাসায় যেয়ে গান শোনাতেন। তারপরে জয়নুল আবেদিনের সাথে তাঁর সাংঘাতিক হদরম ছিল। উনার নলেজটা ছিল চতুর্দিকে। যা তার তাঁর ছেলে মেয়েদের মধ্যেও সাংঘাতিক ভাবে প্রবহমান। বিশেষ করে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে।
আমি প্রতি বছর বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের জার্মান ও সর্ব ইউরোপিয়ান শাখার নেতা হিসাবে কয়েকটা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে থাকি। এ বছর অবশ্য সে সুযোগ হয়নি। কিন্তু কয়েকটা ভার্চুয়াল প্রোগ্রামে অংশ নিয়েছিলাম। সেখানে বক্তাদের লক্ষ করি তারা প্রধানমন্ত্রীর নামের শেষে অহেতুক এবং অপ্রাসঙ্গিক বিশেষণ ব্যবহার করেন। এই শব্দগুলো তারা সূরা মুখস্থ করার মত রপ্ত করেছেন। আর সব অনুষ্ঠানে তারা একই কথা বলেন। এর বাইরে যেতে পারেন না। এদের অনেকেই প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি সাক্ষাৎ পেয়েছেন। কিন্তু জনগণের সামনে তাঁর না জানা কোন তথ্য উপস্থাপন করতে পারেননি। একবার কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা, নূর হোসেন সম্বন্ধে কী মূল্যায়ন করেছেন সেটা কী জানেন। তারা আবোল-তাবোল বকতে শুরু করলেন। তখন তাদের প্রশ্ন করেছিলাম আপনারা কী Hasina – A Daughter’s Tale চলচ্চিত্রটা দেখেছেন? তারা নিশ্চুপ সেটা আবার কী জিনিসরে ভাই? আমাকেই পাগল ঠাওরে বসলো। এরা আওয়ামী লীগের নেতা কিন্তু ১ঘন্টা ২৬মিনিট সময় ব্যয় করে একটা মুভি দেখতে পারে না। যা তাদের নেত্রীর জীবন নিয়ে নির্মিত হয়েছে। এই চলচ্চিত্রটা দেখলেই তারা জানতে পারতো তাদের নেত্রী কেমনে মূল্যায়ন করেছেন নূর হোসেনকে।
শিল্পী শেখ আফজাল হোসেনের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম শেখ হাসিনার সৌজন্যতাবোধ কত উচ্চ মার্গের। ‘৭৫ পরবর্তী কোন সরকার প্রধান বা রাষ্ট্র প্রধানের মধ্যে এই সৌজন্যতা বোধ আমরা কখনও লক্ষ করিনি। আমি সরকারের যে কোন দোষ ত্রুটির উল্লেখ করি অন্য সবার চেয়ে বেশী। এগুলো করতে পারি বঙ্গবন্ধু আর তাঁর কন্যার অনুপ্রেরণাতেই। কারণ তারা দুজনেই গঠনমূলক সমালোচনাকে প্রাধান্য দিয়েছেন।
কয়েকদিন আগে আমার মিয়া ভাই দুঃখ করে বলছিলেন, “আজ কাল অনেককে নিয়ে অনেক কিছু লেখা হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মাতা-পিতাকে নিয়ে তেমন কিছু লেখা হয়নি। তাদেরকে যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে স্মরণ বা মূল্যায়নও করা হয়নি। কথাটা একশ ভাগ ঠিক। তাঁদের ত্যাগ ছাড়া আমরা বঙ্গবন্ধুকে পেতাম না, বঙ্গবন্ধু হিসাবে। ধন্যবাদ শিল্পী শেখ আফজাল হোসেনকে যে তিনি আমাদের স্রোতের বিপরীতে যেয়ে অনন্য এক প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুকে তুলে ধরতে সাহায্য করলেন।