বঙ্গবন্ধু এ শব্দবন্ধ উচ্চারণে আপত্তি কেন?

জনাব ড. কামাল হোসেনের দৈনিক যুগান্তরে ৭ই মার্চে ঐতিহাসিক ভাষণের নেপথ্যে শিরোনামে লেখাটা খুব মনোযোগ সহকারে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়লাম, লেখাটা পড়ে আমি যারপর নাই হতাশ হয়েছি। না উনি কোন তথ্য বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেননি। আমি হতাশ হয়েছি এজন্য যে উনি পুরো লেখাতে জাতির জনক, জাতির পিতা বা বঙ্গবন্ধু এ শব্দগুলো সযত্নে এড়িয়ে গেছেন। অতিতে বিভিন্ন সময়ে উনি শব্দগুলো ব্যবহার করেছেন, বুঝতে পারছি না আজ কেন ব্যতিক্রম।লেখাটা পড়া শুরু করে আমার মনে হয়েছিল লেখক বোধহয় অন্য কোন ড. কামাল হবেন, কিন্তু না আমার ভুল ভাঙল শেষে দেখলাম ড. কামাল হোসেনঃ সভাপতি, গণফোরাম।
বাংলা ভাষায় ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহনকারী সুমিষ্ট কিছু শব্দের মধ্যে বঙ্গবন্ধু অন্যতম।। বঙ্গ দিয়ে এখানে বাংলা ও বাঙ্গালীকে বোঝানো হয়েছে, আর বন্ধু বলতে সেই সময়ে বাঙ্গালীর অধিকার আদায়ে যে ব্যক্তি ত্রাণকর্তার ভূমিকা পালন করেছেন সেই মহামানব শেখ মুজিব কে বোঝানো হয়েছে। দুটি শব্দের এ রকম অভূতপূর্ব সমন্বয়ে গঠিত উপাধি বিশ্বের অন্য কোন ভাষায় বিরল। আমেরিকার বন্ধুকে কি বলবো, Friend of America শব্দগুলোকে কিন্তু একসাথে বঙ্গবন্ধুর মত লেখা যাচ্ছেনা বা একটি শব্দে পরিণত করা যাচ্ছেনা।

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের উপর বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রায় এক ডজন প্রতিবেদন আমি মনোযোগ সহকারে পড়েছি। এ লেখা গুলোর মধ্যে ড. কামাল এবং নির্মল সেন তাঁদের লেখায় বঙ্গবন্ধুকে বঙ্গবন্ধু সম্বোধন করতে পারেননি।

পল্লীবন্ধু এরশাদের মত শেখ মুজিবুর রহমান নিজে নিজে গায়ে বঙ্গবন্ধু ছাপ মারেননি। ১৯৬৯ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পাবার পর রমনার রেসকোর্স ময়দানে ২৩শে ফেব্রুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আয়োজিত গণ সংবর্ধনায় ১০ লাখ জনতার উপস্থিতিতে তৎকালীন ডাকসুর ভিপি তোফায়েল আহমেদ বাঙ্গালী জাতির পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রকৃত বন্ধু হিসাবে অভিহিত করে বঙ্গবন্ধু হিসাবে উল্লেখ করেন। তারপর তিনি উপস্থিত লাখো জনতার কাছে এ ব্যাপারে সমর্থন চাইলেন তখন রমনা রেসকোর্সের দশ লাখ মানুষের উত্তাল সমুদ্র সম্মতি জানিয়ে দু’হাত ঊর্ধ্বে তুলে ধরে। (সূত্র: আজকের কাগজ ২৩শে ফেব্রুয়ারি ২০০৭)
একথা খুবই সত্য যে শেখ মুজিব যদি বঙ্গালীর চোখের মধ্যমণি না হয়ে উঠতেন তথা বঙ্গবন্ধু না হয়ে উঠতেন তাহলে বাংলাদেশ স্বাধীন করা সম্ভব হত না। আর সেক্ষেত্রে ড. কামাল যে স্বাধীন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেছেন তা কি সম্ভব হত? পারতেন কি বাংলাদেশের সংবিধানের প্রণেতা হতে?
আওয়ামীলীগকে লেখা ড. কামালের সেই দীর্ঘ চিঠিটার কথা আজ আবার মনে পড়ছে, সেখানে কিন্তু জনাব কামাল বঙ্গবন্ধুকে বঙ্গবন্ধুই সম্বোধন করেছিলেন। এবং লিখেছিলেন জাতিসংঘে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মত সম্মানিত গুরুদায়িত্ব বঙ্গবন্ধু তাকে দিয়েছিলেন আরও অনেক কিছু।

আমার পরিষ্কার মনে পড়ছে বি.বি.সি’র জরিপে যখন বঙ্গবন্ধু সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী নির্বাচিত হন, তখন ড. কামালের একটা সাক্ষাতকার প্রচার করেছিল। সেদিন ড. কামাল তুরস্কে ছিলেন, টেলিফোনে বি.বি.সি সাক্ষাতকারটি গ্রহণ করেছিল। সেদিনও বঙ্গবন্ধুকে ড. কামাল বঙ্গবন্ধু সম্বোধন করেছেন। জনাব কামালের ভাষ্যানুযায়ী বঙ্গবন্ধু তাকে বিভিন্ন গুরুদায়িত্ব অর্পণ করে সম্মানিত করেছেন। বঙ্গবন্ধু পরবর্তী আওয়ামীলীগ সেটা করেনি বলে উনি নতুন দল করেছেন। উনার দল কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কথা একদিনও বলেনি। বঙ্গবন্ধু উনাকে অনেক দিয়েছে কিন্তু উনি তাঁর জন্য কি করেছেন। সেক্ষেত্রে বিচার করলে আওয়ামীলীগ ড. কামালকে বিতাড়িত করে সঠিক কাজটাই করেছে।

নতুন দল করুক আর যাই করুক ড. কামাল হোসেন বঙ্গবন্ধুকে বঙ্গবন্ধুই বলতেন, কিন্তু হঠাৎ উনার আচরণে একটা পরিবর্তন লক্ষ করছি। সেনাবাহিনী সম্পর্কে উনার সাম্প্রতিক মন্তব্য সংবিধান লঙ্ঘনকারী জিয়া ও এরশাদের অবৈধ ক্ষমতা গ্রহণকে বৈধতা দেয়। যদিও উচ্চ আদালতের রায়ে সে ক্ষমতাগ্রহন অবৈধ। বিভিন্ন সংগঠন থেকে দাবি উঠেছে উনার অবস্থান পরিষ্কার করার। এরপরই উনি ৭ই মার্চের ভাষণ নিয়ে লেখায় বঙ্গবন্ধু শব্দ পরিহার করলেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে উনি তথাকথিত নিরপেক্ষতার মধ্যে ঢুকতে চাচ্ছেন।

সবথেকে বড় সত্য হল বঙ্গবন্ধুকে বঙ্গবন্ধু বলেও আমি উপরে তুলতে পারবো না, না বলেও তাঁর অবস্থান ছোট করতে পারবো না, তিনি যেখানে আছেন সেখানেই থাকবেন। তবে পরিচয় হয়ে যাবে আমার নিজের যে মানুষ হিসাবে, বাঙ্গালী হিসাবে আমি কত দরিদ্র মনের ও সংকীর্ণ মনের।

ড. কামাল হোসেনকে এখনও আমার আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন আইনজীবী বলতে বাধছে না, যদিও আমি জানিনা আন্তর্জাতিক পরিসরে আইনবিদ হিসাবে কি ভূমিকা তিনি রেখেছেন। শুধু এটুকু জানি স্বৈরাচারী এরশাদের শাসনকালে দেশীয় কয়েকটা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের সাথে বাংলাদেশ সরকারের প্রশ্নবিদ্ধ বিভিন্ন চুক্তিতে উনার অবদান সম্পর্কে। তারপরও একজন বাঙ্গালী হিসাবে উনাকে আমার একজন খ্যাতনামা আইনজীবী বলতে বাধে না। কারণ এতে আমার অবস্থান নিচু হয় না বরং কিছুটা উঁচু হয় বলেই আমি মনে করি। কিন্তু যখন দেখলাম বঙ্গবন্ধুর এক সময়ের সহচর বিশ্বস্ত অনুচর তিনি আজকে আর বঙ্গবন্ধুকে বঙ্গবন্ধু বলছেন না, তখন স্বাভাবিক কারণেই আমার মনে প্রশ্ন জাগছে এ মানুষটি এতদিন বলে এসেছেন এখন বলছেন না, তাহলে উনি কি অন্য কোথাও কোন লোভনীয় প্রস্তাব পেয়েছেন?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

লেখকের আরো কিছু পোস্ট