বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের পূর্ণাঙ্গ ভাষণটা কি হারিয়ে গেছে?

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবার দিয়ে মোট চৌদ্দবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভাষণ দিলেন। গত কয়েকবার অর্থাৎ ৬৯তম অধিবেশন থেকে উনি বাংলায় ভাষণ দিলেও আরবি ভাষা দিয়েই ভাষণটা শুরু করেন। গতবার জাতিসংঘ অধিবেশনে দেওয়া আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ভাষণটা যখন শুনি তখন আমি একটু চমকে উঠেছিলাম যে, খালেদা তো বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছে না, তাহলে বিস-মিল্লাহির রাহমানের রাহিম? এটা তো জিয়া, খালেদা ও ফালুদের ট্রেড মার্ক। নড়েচড়ে বসে দেখলাম হ্যাঁ শেখ হাসিনাই আরবি কথাগুলো দিয়ে ভাষণটা শুরু করলেন। এ নিয়ে পরদিন আমার আব্বার সাথে যখন কথা বলি। আব্বা আমাকে বলেছিলেন বাংলাদেশের কত ভাগ মানুষ মুসলমান সেটা দেখতে হবে। আমি সাথে সাথে উত্তর দিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর সময় কি মুসলমান কম ছিল, উনি তো আরবি বলেননি। আমার আব্বা সেদিন এব্যাপারে আর কথা বাড়াননি। বুঝে ফেলেছিলেন চিন্তা না করেই উনি একটা উত্তর দিয়েছেন, সেটা ঠিক হয়নি। সবথেকে বড় কথা জিয়া গংরা সংবিধানে আরবি শব্দ ব্যবহার করে আমাদের ভাষাকে অপমান করেছিল। অপমান করেছিল আমাদের পবিত্র সংবিধানের অসাম্প্রদায়িক চরিত্রকে। বিভেদ সৃষ্টি করেছিল বাঙ্গালী জাতির মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ঢুকিয়ে।
আওয়ামী লীগ খেলাফতের সাথে চুক্তি, হেফাজতের সাথে মধুচন্দ্রিমার পর থেকে এই ব্যাপারগুলো লক্ষ করা যাচ্ছে। আজকাল আওয়ামী লীগ নেতারা এবং আমাদের প্রধানমন্ত্রীও ইসলামী পরিভাষা ব্যবহার করছেন। আমি জাতিসংঘে দেওয়া শেখ হাসিনার ৬৯তম, ৭০তম ভাষণটাও গতকাল শুনলাম সেখানেও উনি বিস-মিল্লাহির রাহমানের রাহিম দিয়ে ভাষণগুলো শুরু করেছেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ধর্মভীরু, উনার বিশ্বাস নিয়ে আমার কোন প্রশ্ন নেই, আপত্তিও নেই। আমার প্রশ্ন কথাগুলো কেন আরবিতে বলতে হবে। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে দাবি করেছে বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষার মর্যাদা দেবার জন্য। যে দেশের প্রধান মন্ত্রী তাঁর মাতৃভাষাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষার দাবি জানাচ্ছেন তিনি তাঁর ভাষণ শুরু করছেন আরবি ভাষায়। ব্যাপারটা হাস্যকর হয়ে যাচ্ছে। আর দাবির যৌক্তিকতা নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। উনি চাইলেই কথাগুলো বাংলায় বলতে পারতেন যে, “পরমকরুনাময় বিধাতার নামে।” এতে বিধাতাও খুশি থাকতেন, বাঙ্গালীও খুশি থাকতো, মৌলবাদীরাও কিছু বলতে পারতো না। সর্বোপরি বিশ্ব পরিষদেও দাবিটা জোরালো থাকতো। আর প্রধানমন্ত্রীও জনগণের প্রধানমন্ত্রী হতেন একশ ভাগ। কিন্তু এখন উনি যত না জনগণের তার চেয়ে বেশী মুসলমানের নেত্রী। এটা আসলেই আমাদের দুর্ভাগ্য জন নেত্রী শেখ হাসিনাকে জিয়া, খালেদার ট্রেডমার্কের সাথে আপোষ করতে হচ্ছে। আর এই আপোষ কিন্তু জাতিয় ঐক্যকে সুদৃঢ় করেছে তাও না। এরপর যে কারণটা জোরাল আরবি ভাষা দিয়ে ভাষণ শুরু করার তা হল, আরবিভাষী মধ্যপ্রাচ্য আমাদের অনেক সাহায্য করে বিধায় তাদেরকে খুশি করার জন্য বিস-মিল্লাহির রাহমানের রাহিম। সেক্ষেত্রেও একটা কথা থাকে আর তাহলো বাংলাদেশেকে সবথেকে বেশী সাহায্যকারী দেশ হল জাপান। তাহলে তো আমাদের প্রধানমন্ত্রীর জাপানি ভাষা দিয়ে শুরু করা উচিত ছিল।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব জনাব মোহাম্মদ আলী “দুই নেত্রী? একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ” শিরোনামে একটা নিবন্ধে লিখেছেন। “এই লেখায় দুই নেত্রী সম্পর্কে বাস্তব অভিজ্ঞতা, বিভিন্ন তথ্য ও ঘটনাবলীর আলোকে যে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা হল তারপর আশা করি কেউ আর দুই নেত্রীকে এক পাল্লায় মাপার চেষ্টা করবেন না। শেখ হাসিনাকে ও খালেদা জিয়াকে অবশ্যই ভিন্ন মানদণ্ডে মূল্যায়ন করতে হবে। কারণ, প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাদের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য।”
ঠিক সেই একই কারণে আমার অভিযোগ কেন বঙ্গবন্ধু কন্যাকে, জন নেত্রী শেখ হাসিনাকে জিয়া, খালেদাকে অনুকরণ করতে হবে? আসলে শেখ হাসিনাকে শুধু বঙ্গবন্ধু কন্যা হিসাবে দেখলে উনার সঠিক মূল্যায়ন করা হয় না। শেখ হাসিনা নিজ যোগ্যতায় উনাকে এ উচ্চতায় নিয়ে এসেছেন। ১৯৮১ সালের ১৭মে থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যেভাবে জাতিকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তা বিশ্বে বিরল। উনি বঙ্গবন্ধুর মত সাধারণ কর্মী থেকে দলের সর্বোচ্চ পদে না আসলেও দিনে দিনে নিজেকে অসম্ভব এক উচ্চতায় নিয়ে এসেছেন সাধনা ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে। মৃত্যুকে উনি তোয়াক্কা করেন বলে মনে হয় না। করলে যাকে উনিশ/বিশ বার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে উনি রাজনীতি ছেড়ে দিতেন। অনেক বুদ্ধু মনে করেন মাইনাস টু ফর্মুলা ছিল সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়। না সেটা ছিল নির্ভেজাল মাইনাস ওয়ান বা মাইনাস শেখ হাসিনা ফর্মুলা। এব্যাপারে অনেক প্রমাণ দেওয়া যাবে আজ এখানে সে প্রসঙ্গ অপ্রাসঙ্গিক। উনি যদি বিদেশে থেকে যেতেন কোন সমস্যা হত না। কিন্তু বাবার মতই উনার জনগণকে একা ফেলে নিজে মুক্ত থাকতে চাননি। তাইতো দেশে ফিরে বন্দি জীবনকে শ্রেয় মনে করেছিলেন। তাই তাঁর অদম্য ইচ্ছার কাছে দেশে ফেরা কেউ ঠেকাতে পারেনি।
এমন একজন নেত্রী যখন জিয়া খালেদার আরবি প্রীতির কাছে আত্মসমর্পণ করেন তখন খারাপ লাগে কষ্ট হয়। জিয়া এমন এক স্ববিরোধী কুচক্রী যে কিনা সংবিধানের মুসলমানি দিয়ে সংবিধানকে মুসলমান করেছিল। আর একশ’র উপরে মদের লাইসেন্স দিয়েছিল। আর খালেদার ঘরে কি পরিমাণ মদের বোতল ছিল তা দেশবাসী দেখেছে, জেনেছে সেনানিবাসের বাড়ী ছাড়ার সময়। তখন বি এন পির চামচারা বলেছিল সরকার ঐসব মদের বোতল ওখানে রেখে দিয়েছে। আর সরকারের বিশেষজ্ঞরা চুপচাপ সে কথা হজম করলেন। খালেদা জিয়া ও তার কর্মচারীদের আঙ্গুলের ছাপ পরীক্ষা নিরীক্ষা করলেই তো সব বেরিয়ে আসতো যে খালেদা কি পরিমাণ মদ গেলে। সম্ভবত নব্বই সালে, একটা ছবি দেখেছিলাম শহিদুল্লাহ হলে এক বন্ধুর কাছে খালেদা আর ড কামাল একসাথে বসে মদ গিলছে। জিয়া যে সময় মদের লাইসেন্স দেয় সে সময় আমাদের আলমডাঙ্গা উপজেলার একজনও মদের লাইসেন্স পেয়েছিলেন।
আমার এক ছোটভাই আমার একটা লেখায় মন্তব্য করেছিল, “যে শেখ হাসিনা যা আজকে ভাবে সারাবিশ্ব নাকি তা একদিন পরে ভাবে।” আর আমি মনে করি বঙ্গবন্ধু চল্লিশ/বিয়াল্লিশ বছর আগে যা ভেবেছেন শেখ হাসিনা বা সারা বিশ্ব সেটা এখনও ভাবতে পারছে না। বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে যে ভাষণ দিয়েছিলেন তা একবার মনোযোগ সহকারে শুনলেই বোঝা যাবে। বঙ্গবন্ধুর চেয়ে বড় মুসলমান বাংলাদেশে আছে নাকি? উনি খাটি মুসলমান ছিলেন বলেই ধর্ম আর রাষ্ট্রকে এক করেননি। উনি ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেছেন এবং তা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। আর উনার কন্যার সময় তা অবহেলিত। আমি একথা বলতে পারছি এ কারণে যে আমি বঙ্গবন্ধুকে ভালবাসি, শ্রদ্ধা করি। যারা হালে আওয়ামী লীগে ঢুকেছে বা যে সব রাজাকার পরিবারের লোকজন এখন আওয়ামী লীগে ঘাপটি মেরে আছে তারা হয়তো জ্বলে উঠবে। কিন্তু আমাদের নেত্রী চামচামো পছন্দ করেন না। উনি কেউ গঠনমূলক সমালোচনা করলে সেটা গ্রহণ করেন। যেখানে প্রশ্নটা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নিয়ে সেখানে আমি কিছু রেখে ঢেকে বলতে পারিনা।
দি টেলিগ্রাফে, ১০ই মার্চ ১৯৭১ ডেভিড লোশাকের একটা প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। উনি লিখেছিলেন, “বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্রের নেতারা যে আপসরফাই করে থাকুন না কেন, দুই জাতিকে একত্রে রাখার যে-নিরীক্ষা করা হয়েছে, তা ব্যর্থ হয়ে পড়েছে। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে খুবই সাধারণ একটি সত্য যে এখানে দুই জাতি রয়েছে। এদের কোন সাধারণ স্বার্থ নেই, কোন পারস্পরিক নির্ভরতা নেই, কোন সাধারণ ভাষা বা খাদ্যাভ্যাস নেই এবং এমনকি ইসলামও তাদের একত্রে রাখতে পারে না। শেষ যে-বিষয়টি বোঝার দরকার তা হল, ইসলাম কোন ঐক্যের শক্তি নয়। এটা মধ্যপ্রাচ্যে প্রমাণিত হয় নি; এখানেও হচ্ছে না।”
ধর্ম কোন ঐক্যের প্রতীক হতে পারে না এতে সেটাই প্রমাণিত হয়েছে। অতএব কেউ যদি ইসলাম ধর্ম পালন করে সে মুসলমান। কিন্তু এটা এ অর্থ বহন করে না সব মুসলমান এক জাত। একটা জাতীকে কোনভাবেই শুধু ধর্ম আর ভাষা দিয়ে নির্ধারণ বা সংজ্ঞায়িত করা যায় না। যদি যেত তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে শুধু একটা দেশ হত। কারণ সেখানে ভাষা ও ধর্ম এক কিন্তু অনেক দেশ। লেবাননে মুসলমান খ্রিষ্টান মিলে বসবাস তারা জাতী হিসাবে লেবানিজ তাঁদের পরিচয় লেবানিজ। আবার যদি আমরা ল্যাটিন আমেরিকার দিকে তাকায় তাহলে দেখি ব্রাজিল ছাড়া সেখানে ভাষা এক কিন্তু বহু দেশ বহু জাতী। একটা জাতী নির্ধারিত হয় তার ভাষা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, খাদ্য অভ্যাস, ভৌগলিক অবস্থান ইত্যাদির উপর নির্ভর করে। শুধু ধর্ম আর ভাষার উপর নির্ভর করে না।
কট্টর পাকিস্তানবাদীদের প্রতি ওয়ালি খানের বিখ্যাত উক্তি: “আমি ৬ হাজার বছর ধরে পাখতুন, ১৩০০ বছর ধরে মুসলমান ও ২৫ বছর ধরে পাকিস্তানি।” তেমন আমরাও আগে বাঙ্গালী তারপর মুসলমান। আর আরবিভাষী তো কোনদিনই না।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ারও অনেক পরে আমরা জাতিসংঘের সদস্য পদ পেয়েছি, তারিখটা ছিল ১৭ই সেপ্টেম্বর ১৯৭৪। আর জাতীর জনক জাতিসংঘে ভাষণ দিয়েছিলেন ২৫শে সেপ্টেম্বর ১৯৭৪। অনেকেই এখন বলেন চীন আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র। চীন কখনও আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র ছিল না এখনও না। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় চীন বলেছিল তথাকথিত বাংলাদেশ। তারপর বাংলাদেশ যাতে জাতিসংঘের সদস্যপদ না পায় সেজন্য চীন ভেটো দিয়েছিল। এতে বঙ্গবন্ধু খুব দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। ২৫শে সেপ্টেম্বর ১৯৭৪ মানবজাতির পার্লামেন্টে বঙ্গবন্ধু বাংলায় ভাষণ দিয়ে যে আলোয় আমাদের আলোকিত করেছিলেন তা তাঁর কন্যা অনুগ্রহ করে অব্যাহত রাখবেন এই আশা রাখি। অনুগ্রহ করে ভবিষ্যতে আরবি দিয়ে শুরু করে আমাদের মাতৃভাষাকে খাট করবেন না। বিস-মিল্লাহির রাহমানের রাহিম বাংলাদেশের অনেকেই হয়তো বলেন কিন্তু তার দশভাগ মানুষ এর অর্থ বোঝে কিনা সন্দেহ আছে।
এরপর দেখা যাক প্রধানমন্ত্রী ৭২তম অধিবেশনে কি বললেন। বঙ্গবন্ধু যেমন দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ৭ই মার্চ ১৯৭১ জাতীর সামনে হাজির হয়েছিলেন। তেমনি জন নেত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় পরিচয়ের বেড়াজাল ডিঙ্গিয়ে বিশ্ব পরিষদে, একজন বিশ্ব নেত্রীর মত দুঃখ ভারাক্রান্ত মন হাজির হয়েছিলেন। উনার দুঃখের কারণ ছিল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। তাদের উপর অত্যাচার উনাকে ব্যথিত করে। কারণ কষ্ট কি জিনিস সেটা শেখ হাসিনার চেয়ে আর কেউ, বর্তমান পৃথিবীতে অনুভব করেন বলে আমি অন্তত বিশ্বাস করি না। যত হৃদয়ে রক্তক্ষরণ উনার হয়েছে বা হচ্ছে তার নজির বিশ্বে কি দ্বিতীয়টি আছে? আমাদের প্রধানমন্ত্রী ছয় বছর উদ্বাস্তু জীবন যাপন করেছেন। সেকথা উনি তাঁর ভাষণে উল্লেখ করেছেন। আমাদের নেত্রী সেদিন যখন বক্তব্য দিয়েছেন বিশ্ব নেত্রীর মতই। উনার কল্যাণে বাংলাদেশ আজ অনেক বেশী মর্যাদার আসনে আসীন বিশ্বমঞ্চে। উনি বলেছেন, রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশ কি কি ব্যবস্থা নিয়েছে। বাংলাদেশের এখনও অনেক সমস্যা আছে। তারপরও আমাদের সরকার ও সরকার প্রধান যে পদক্ষেপ নিয়েছেন তা দেখে মনে হয় না বিশ্বের একটা ক্ষুদ্র দেশ বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পদক্ষেপ বিশ্বনেতাদের কাছে প্রশংসিত হয়েছে।
বিশ্বনেতাদের এই প্রশংসার সুফল কিছু নেই কিন্তু সুদূরপ্রসারী কুফল বাংলাদেশের জন্য অপেক্ষা করছে। কয়েকদিন আগে আমার মেজ চাচার সাথে টেলিফোনে কথা বলছিলাম। কথা প্রসঙ্গে জাতিসংঘের ভাষণের কথা উঠেছিল। উনি বললেন, “সরকারের অর্জন অনেক কিন্তু সব অর্জনকে ধূলিসাৎ করে দেবে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুরা। উনি আরও উল্লেখ করেন রোহিঙ্গারা বিহারিদের মত। নোংরা পরিবেশে থাকা। যেখানে থাকবে সেখানেই পায়খানা/পেশাব করবে ইত্যাদি।” যারা আসছে সবই প্রায় নিরক্ষর এবং অশিক্ষিত। নিরক্ষর জনগোষ্ঠীর চেয়ে অশিক্ষিত জনগোষ্ঠী ভয়ঙ্কর। ঢালাওভাবে রোহিঙ্গা আসতে থাকলে জঙ্গিরাও ঢুকবে সেটাও মাথায় রাখতে হবে। ইতিমধ্যে দেখা গেছে রোহিঙ্গারা ইয়াবা বেচা শুরু করেছে।
প্রধানমন্ত্রীর ভাষণকে মানবিক দিক দিয়ে বিবেচনা করলে প্রশ্নাতীত। কিন্তু আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা, আর্থিক সামর্থ্য সবদিক বিবেচনা করলে, আমরা কি এ ভার দীর্ঘকাল বহন করতে পারবো? অনেকে বলছেন বা বলবেন যে, ১৯৭১ সালে আমারাও এক কোটি মানুষ ইন্ডিয়াতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। আমাদের পরিস্থিতি আর রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি কোন অবস্থায়ই এক না। আমরা স্বাধীনতার জন্য লড়ছিলাম। সেখানে সুনির্দিষ্ট একটা ব্যাপার ছিল। ইন্দিরা গান্ধী যখন ইন্ডিয়ার তথ্যমন্ত্রী ছিলেন তখন লন্ডনেই তারাপদ বসুর বাড়িতে বঙ্গবন্ধু ও ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে প্রথম সাক্ষাৎ হয়। বঙ্গবন্ধু বলেন, “গণতান্ত্রিক পথে ক্ষমতা হস্তান্তরিত না হলে তিনি ভারতের সহযোগিতা চান।” তারাপদ বসু দুই নেতার দূত হিসেবে কাজ করতেন। দিল্লির বার্তা ঢাকায় আর ঢাকার বার্তা দিল্লিতে পৌঁছে দিতেন। ইন্ডিয়া বাংলাদেশী শরণার্থীদের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল। এবং তাঁরা জানতো বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই এটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। অতএব বাংলাদেশ ও আরাকানিদের সমস্যার প্রেক্ষাপট পুরো ভিন্ন।
বছর দুয়েক আগে যখন সিরিয়ান শরণার্থীর ঢল নেমেছিল তখন জার্মানির চ্যাঞ্চেলর আংগেলা মের্কেল (Angela Merkel) আইন ভঙ্গ করে হাংগেরি থেকে সিরিয়ানদের জার্মানিতে নিয়ে এসেছিলেন। জার্মানির আইন অনুযায়ী কেউ যখন অন্যকোন দেশের উপর দিয়ে জার্মানিতে এসে আশ্রয় প্রার্থনা করে তাকে সে দেশে ফেরত পাঠানো হয়। অতীতে এরকম হাজার হাজার নজির আছে। আমার এক বন্ধুর ভাইকে স্লোভাকিয়াতে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু আংগেলা মের্কেল আইনের সংশোধন না করেই প্রায় এক মিলিয়ন সিরিয়ানকে জার্মানিতে নিয়ে আসলেন। উনার হয়ত বিশ্ব নেত্রী হবার খায়েশ হয়েছিল এজন্য উনি এটা করেছিলেন। এর ফল অবশ্য পেয়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তার দলের জনপ্রিয়তা সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে গেছে। মের্কেলের জোট ও এস পি ডি গতবারের তুলনায় যে ভোট কম পেয়েছে ঠিক সেই ভোটগুলোই চারবছর আগে গঠিত আ.এফ.ডে পেয়েছে। আল্টারনাটিভে ফুর ডয়েসল্যান্ড (জার্মানির জন্য বিকল্প) আ.এফ.ডে যে নির্বাচনী ফল করেছে তা অকল্পনীয় তবে অস্বাভাবিক নয়। হল্যান্ড ও অষ্ট্রিয়াতেও উগ্র জাতীয়তাবাদীরা খুবই ভাল ফল করেছে। জার্মানির নির্বাচনী ফল আরও খারাপ হতে পারত। আংগেলা মের্কেল তার দীর্ঘ ক্ষমতাকালীন সময়ে গরীবকে আরও গরীব করেছেন আর ধনীকে অসম্ভব ধনী বানিয়েছেন। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের উনি নির্মূল করেছেন। আর নির্বিচারে আইন ভঙ্গ করে শরণার্থী আমদানি করেছেন যারা জার্মান সমাজ ব্যবস্থাকে ভিত সন্ত্রস্ত করে তুলেছে। আর সেই কারণেই নব্য নাৎসিরা নির্বাচনে তৃতীয় বৃহত্তম দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
সর্বোপরি জার্মানি যা করেছে আমরা তা করতে পারিনা। নীচের পরিসংখ্যান থেকে তা বোঝা যাবে।

জার্মানি/ বাংলাদেশ
আয়তন ৩৫৭,১৬৮ বর্গ কি.মি. ১,৪৭,৫৭০ বর্গ কি.মি.
জনসংখ্যা ৮০,৩২৭,৯০০ জন ১৬৩,১৮৭,০০০ জন
জনসংখ্যার ঘনত্ব ২২৭ জন প্রতি বর্গ কি.মি. ১১০৬ জন প্রতি বর্গ কি.মি.
মাথাপিছু আয় ৪৮,১১১ ডলার ৪,২০৭ ডলার

আমাদের সবথেকে বড় সমস্যা হচ্ছে ভূমি। আমাদের আয় বাড়লেও ভূমি বাড়ছে না এবং কোন সম্ভাবনা নেই। বরং কিছু অংশ পানির নীচে তলিয়ে যেতে পারে। চল্লিশ বছর ধরে রোহিঙ্গা সমস্যা চলছে। খুব সহজে এর কোন সমাধান হবে তা মনে হচ্ছে না। সিরিয়ার শরণার্থীর জন্য ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন কিন্তু তার সীমান্ত পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে। এখন আর তুরস্ক থেকে কোন শরণার্থী এদিকে আসতে পারছে না। আমার প্রশ্ন এখন কি সিরিয়ায় সমস্যা নেই। এখন কি সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে না? হ্যাঁ এখনও হচ্ছে কিন্তু তথাকথিত মানবতাবাদী ইউরোপিয়ানরা এখন চুপ। যতক্ষণ এটা নিয়ে রাজনীতি করলে নিজের সুবিধা ছিল ততক্ষণ মের্কেল ও তার ইউরোপিয়ান মিত্ররা এ নিয়ে মেতেছেন। এখন উনাদের মোহভঙ্গ হয়েছে। বিলিয়ন বিলিয়ন ইউরো দিয়ে তুর্কির রাষ্ট্রপতির অনেক অগণতান্ত্রিক ও অমানবিক কার্যকলাপ মেনে নিয়ে তাকে বাগে এনেছেন। এরদোয়ান এসব পয়সা সামান্য কিছু শরণার্থীদের পিছনে আর বাকি পয়সা তার ও সাঙ্গপাঙ্গদের পকেটে ভরছেন।
সিরিয়াতে যে সমস্যা তার পিছনে জার্মানিরও হাত আছে। জার্মানির নূর্নবের্গ শহরের নদী বন্দরের কাছে একটা অত্যাধুনিক অস্ত্র কারখানা আছে। এটা আমার বাসা থেকে ৩/৪ কিলোমিটার হবে। সেখানে যে অস্ত্র তৈরি হয়, সে অস্ত্র জার্মানি আই এস কে সরবরাহ করেছিল। আবার এরাই আই এস বা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। স্ববিরোধিতার নগ্ন বহিঃপ্রকাশ। যত মানবতাবাদী উইরোপিয়ানরা নিজেদেরকে প্রমাণ করার চেষ্টা করুক না কেন এরা কোনদিনই তা না। তবে এরা নিজেদের জনগণের ব্যাপারে সচেতন। অন্যদেশে কি হচ্ছে সেটা এরা তোয়াক্কা করে না। তবে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্য কিছু বিবৃতি দেয় মাত্র। উন্নত দেশগুলো কোন সময়ই চায় না যুদ্ধ বন্দ হয়ে শান্তি ফিরে আসুক। শান্তি ফিরে আসলে অস্ত্র বিক্রি কেমনে হবে। আর অস্ত্র বিক্রি না হলে টাকা কোথা থেকে আসবে।
বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের উস্কানি দিয়ে কিছু করায়নি। জিয়ার সময় থেকে সমস্যা শুরু হয়েছে উনি এটা শেষ করার কোন উদ্যোগ নেননি। পরবর্তী সরকার গুলোরও রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোন রূপরেখা নেই। আগে চার লাখ ছিল এখন সাত/আট লাখের উপর এসে গেছে, আরও নাকি আসছে।
জাতিসংঘ কড়া পদক্ষেপ নিলে এজাতীয় ঘটনা ঘটত না। যেখানে রোহিঙ্গাদের বাস সেই এলাকা প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। পশ্চিমাদের নজর সেদিকে। আমেরিকা নিজেরটা মজুত রেখে অন্যদেশের গুলো শেষ করতে চাই। জার্মানি প্রযুক্তি যন্ত্র বিক্রি করতে চাই। সবাই নিজ তালে ব্যস্ত। তাইতো নোবেল ডাইনি সূচিকে এখন পর্যন্ত কেউ কড়া করে কিছু বলছে না। দীর্ঘদিন স্বৈর শাসকের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত মিয়ানমার এখন নিজেরাই অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত। ডাইনি সূচি ভোটে জেতার আগে অনেক আশ্বাস দিয়েছেন এখন তা পূরণ করতে হবে না করলে ক্ষমতা হারানোর ভয় আছে। এইজন্য উন্নত বিশ্বের সাথে তাকে আপোষ করতে হবে। প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলন করতে হলে আরাকানিদের সরাতে হবে। তা নাহলে প্রকল্পগুলো হাতে নেওয়া যাবে না। রোহিঙ্গারা দুর্বল তাই তাদেরকে মিথ্যা অজুহাতে সরানো সম্ভব হয়েছে সহজে। আর রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঢুকিয়ে বার্মা সমুদ্র সীমা মামলায় হারের একটা প্রতিশোধও হয়তো নিলো। এখন যদি বার্মা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়েও নেয় ঠিক আগের জায়গায় তাদের পুনর্বাসন করবে বলে আমার মনে হয় না। বার্মা চেষ্টা করবে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে না নিতে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার কি ভূমিকা নিচ্ছে তার উপর অনেক কিছু নির্ভর করবে। এই মুহূর্তে আমাদের সরকারকে কঠোর অবস্থানে যেতে হবে। আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করতে হবে। অন্যথায় ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করবে এ সমস্যা।
কয়েকদিন আগে পত্রিকায় দেখলাম আমাদের সেতু মন্ত্রী বলেছেন, “রোহিঙ্গাদের জন্য স্কুলের ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং তাদের সব সুবিধার আওতায় আনা হবে ইত্যাদি।” এখানে প্রথম প্রশ্নটা হল রোহিঙ্গাদের জন্য যা কিছু করা হচ্ছে সেগুলো কি আমাদের নিজস্ব সম্পদ থেকে না বিদেশি সাহায্য থেকে। যদি এসব সাহায্য আমাদের নিজস্ব সম্পদ বা তহবিল থকে করা হয়, এক সময় গন অসন্তোষ দেখা দেবে। ইউরোপের মত প্রচণ্ড উগ্রবাদী সংগঠনের উত্থান হবে। যারা ভবিষ্যতে তৃতীয় বা দ্বিতীয় শক্তি হিসাবে দেখা দেবে। যারা সরকারকে কর প্রদান করে তাঁরা রাগান্বিত হবে। আমারা যারা বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করি তাদের মধ্যেও সরকারের প্রতি বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি হবে। কারণ আমাদের বাচ্চাদের স্কুল নেই পর্যাপ্ত, সেখানে উদ্বাস্তুদের জন্য সব সুবিধার ব্যবস্থা কেউ মেনে নেবে না। রোহিঙ্গাদের জন্য সব সুবিধার ব্যবস্থা করা হলে এরা সহজে এ দেশ ছাড়বে না। ধরে নেওয়া যায় এই সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হবে। আর বাংলাদেশ যদি এদের দায়িত্ব নেয় তাহলে এক সময় বিশ্বের যে সব দেশ এখন অল্প বিস্তর সাহায্য করছে তারাও এক সময় পিছুটান দেবে। অতীত অভিজ্ঞতা তায়ই বলে।
বেশ কয়েক বছর আগে বরিশাল এলাকায় সিডরের আঘাতে বাংলাদেশ যখন নাস্তানাবুদ তখন বিশ্বের অনেক ধনী দেশ বিশাল সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। যতদূর জানি সে সব সাহায্য আজও বাংলাদেশে পৌঁছেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র খাদ্যের জাহাজ ডুবিয়ে, বিভিন্ন টাল বাহানা করে বঙ্গবন্ধুর সরকারকে যে কঠিন অবস্থায় ফেলেছিল সেসব এত দ্রুত ভুলে গেলে চলবে না। অথচ সে সময় উদ্বৃত্ত খাদ্য আমেরিকা সাগরে ফেলে দিয়েছে যাতে বাজারে গমের দাম না কমে। এসব কাণ্ড কিন্তু মানবতা বিরোধী ছিল সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের একার না, এটা এখন সারা বিশ্বের সমস্যা।
তুরস্কের একনায়ক রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশ সীমান্ত খুলে দেওয়ায় স্বাগত জানিয়েছে এবং এটা অব্যাহত রাখার আহবান জানিয়েছে। আর বলেছে তার দেশ রোহিঙ্গাদের ব্যয়ভার বহন করবে। তুরস্ককে আমরা কতটা বিশ্বাস করতে পারি। কিছু দিন আগের অভিজ্ঞতা ভাল না। তারা আমাদের দেশের আভ্যন্তরীণ সর্বোচ্চ স্পর্শকাতর ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেছিল। রোহিঙ্গারা মুসলমান না হয়ে অন্যকোন ধর্মাম্বলম্বী হলে কি এই আশ্বাস দিত। আর এই আশ্বাস যে বাস্তবায়ন করবে তুরস্ক তার কোন নিশ্চয়তা আছে কি?
ও.আই.সি নাকি মুসলমানদের প্রাণের সংগঠন। এই প্রাণের সংগঠনের নাম ইংলিশে কেন? এই সংগঠনের নাম কি আরবি ভাষায় হতে পারতো না? নাকি Organisation of Islamic Cooperation এই শব্দগুলোর আরবি কোন শব্দ নেই? কারো ধর্ম বিশ্বাসে আঘাত করা আমি সমীচীন মনে করিনা। কিন্তু আমার মাতৃ ভাষার উপর আঘাত হয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে। তাই শুধু বলেছি কথাগুলো প্রধানমন্ত্রী বাংলায় বলতে পারতেন। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে ভাষার জন্য আন্দোলন করে আমাদের ভাইয়েরা শহিদ হয়েছেন। আমাদের প্রধান মন্ত্রী যখন অন্য ভাষায় তাঁর ভাষণ শুরু করেন তখন পাকিস্তানিদের উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার অপরাধ একটু হলেও লঘু হয়ে যায়। আরবি ভাষার ধারক ও বাহকরাই যখন তাদের সংগঠনের নাম দিয়েছেন ইংলিশ ভাষায়। আর আরবিতে না বললে যদি সমস্যা হয় তাহলে কেন বাংলাসহ বিশ্বের অন্যান্য ভাষায় কোরআন শরীফের ভাষান্তর করা হচ্ছে। তুর্কি, জার্মান ও ইউরোপিয়ান মুসলমানরা তাদের নিজ নিজ ভাষায় নামাজ পড়ে। Organisation of Islamic Cooperation ১৯৭১ সালে কি ভূমিকা নিয়েছিল? তারা পাকিস্তানি ধর্ষকদের পক্ষে কথা বলেছিল। ফিলিস্তিনে মুসলমানদের উপর যে অত্যাচার ইজরাইল করছে তার বিরুদ্ধে কি কোন কার্যকর পদক্ষেপ আজ পর্যন্ত ইংলিশ নামধারী Organisation of Islamic Cooperation নিয়েছে? অতএব OIC র কর্ণধার দেশগুলো তো রাজতন্ত্র ঠেকাতে এবং ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে যুক্তরাষ্ট্রের তাঁবেদারিতে ব্যস্ত। OIC যেখানে ফিলস্তিনি মুসলমানদের দীর্ঘদিনের সমস্যার কার্যকরী কোন পদক্ষেপ নেয়নি সেখানে রোহিঙ্গাদের ব্যাপারেও কিছু করবে বলে মনে হয় না। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ফিলিস্তিনীদের পক্ষে কথা বলেছেন। উনি খন্দকার মোশতাকের মাধ্যমে ইজরাইলের বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। এবং বিনিময়ে তাদের সাথে কোন রকম কূটনৈতিক সম্পর্কও স্থাপন করেননি।
OIC নিজেদের স্বার্থে তেলের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে বুশ, ক্লিনটন, ট্রাম্পের কথা মত ইজরাইলের স্বার্থই দেখবে। বাংলাদেশ থেকে যে সব কর্মী মধ্যপ্রাচ্যে কাজে যায় তাদের সাথে তারা কি ব্যবহার করে। ইসলামের কোথায় সেটা আছে যে এটা তারা করতে পারে? বাংলাদেশের শিশুদের দিয়ে উঠের দৌড়ের মত অমানবিক কাজগুলো মধ্যপ্রাচ্যের মানুষগুলো করেছে। বলতে পারবে কেউ কেন তারা তাদের নিজেদের বাচ্চাদের দিয়ে ওই খেলা খেলেনি। আমি গত তেইশ বছরে কোন জার্মানের কাছ থেকে বৈষম্যমূলক কোন আচরণ পাইনি। মনিব কর্মচারী সব একসাথে এক টেবিলে বসে খেয়েছি, খায়। আল্লাহ সর্বশক্তিমান উনি সব বোঝেন অতএব আমার ব্যক্তিগত মত আমি “পরমকরুনাময় বিধাতার নামে” বা “বিস-মিল্লাহির রাহমানের রাহিম” যাই বলি আল্লাহর বুঝতে অসুবিধা হবার কথা না। আমাদের প্রধানমন্ত্রী যদি OICর উপর ভরসা করে থাকেন সেটা বড় ভুল হবে। উনার সমস্যা উনাকেই দেখতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যের ভূমি তো অনেক, অফুরন্ত সম্পদ ওরা কেন রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিচ্ছে না? মুসলমান সব নাকি ভাই ভাই। এ কেমন ভাই? কেন সে সব দেশে অভিবাসন আইন এত কঠিন? কেন ইন্ডিয়া মুসলমানদের জন্য অভিভাষণ আইন কঠিন করলে সমালোচনা হয়, আর মধ্যপ্রাচ্যের বেলায় নিশ্চুপ। কেন সিরিয়ার মুসলমানদের উইরোপের অনইসলামিক পরিবেশে আশ্রয় নিতে হয়। কেন সিরিয়ানরা যে দেশে ঠিকমত হিজাব পালন করা যায় না সে দেশে আসার ব্যাপারে এত আগ্রহী? কেন তারা ইসলামি দেশ তুর্কিতে থাকতে চায় না। এর উত্তর একটায় ওরা মুসলমান হলেও ওদের ওখানে মানবাধিকার নেই।
উপরোক্ত কারণে আমি প্রধানমন্ত্রীর জাতীসংগের ভাষণে হতাশই হয়েছি। উনি বলেছেন উনি কি কি ব্যবস্থা নিয়েছেন। উনি উনার আর্থিক ও ভূমির সীমাবদ্ধতার কথা একবারও বলেননি। আমদের দেশে লোক সংখ্যার এমন চাপ যে ট্রাফিক জ্যামে আটকা পড়ে এম্বুলেন্সের মধ্যেই রোগী মারা যায়, হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না। আমি মনে করি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর এসব ব্যাপারগুলো খোলাখুলি বলা উচিত ছিল। আমাদের আর্থিক অপ্রতুলতার কথাও দৃঢ়ভাবে উল্লেখ করা উচিত ছিল। এরপর উনি বলতে পারতেন তাতক্ষনিকভাবে মানবিক কারণে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ সময় তাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়া সম্ভব হবে না। রোহিঙ্গাদের জীবন যাপনের জন্য যা কিছু দরকার তার দায়ভার জাতিসংঘকে নিতে হবে অন্যথায় তারা না খেয়ে থাকলে বাংলাদেশ তার দায় দায়িত্ব নেবে না। আর শরণার্থীদের বিশ্বের সবদেশে ভূমি ও জনসংখ্যার অনুপাতে বণ্টন করতে হবে। অন্যথায় বাংলাদেশ তার সীমান্ত ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মত বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবে। প্রধানমন্ত্রী এসব সমস্যার কথা উল্লেখ না করায় বিশ্ব এখন মনে করবে সব তো ঠিকমতই চলছে, বাংলাদেশ তো সব ব্যবস্থা নিয়েছে। এতে হয়তো আমাদের প্রধানমন্ত্রীর নাম নোবেল পুরস্কারের জন্য কেউ প্রস্তাব করবে। ইতিমধ্যে অনেকে এ নিয়ে লেখালেখি সুরু করেছে। জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতিও এ নিয়ে লিখেছেন।
নোবেল কোন রাজনীতিবিদের যোগ্যতার মাপকাঠি হতে পারে না। সূচি নোবেল ধারি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আধাকালো রাষ্ট্রপতিও নোবেল পেয়েছিলেন তাও আবার রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায়। উনি নিজেই জানেন না কি কাজের জন্য উনাকে নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হয়েছিল। এই নোবেলধারি আফ্রো আমেরিকান রাষ্ট্রপতি ক্ষমতায় আসার আগে বলেছিলেন, “উনি ক্ষমতায় গেলে গুয়ান্তানামো বে তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে সামরিক ঘাটি আছে তা বন্ধ করে দেওয়া হবে। ক্ষমতায় এসে উনি ঐ সামরিক ঘাটি বন্ধ করেছিলেন ঠিকই। কিন্তু কয়েক মাস পর আবার সেই ঘাটি চালু করা হয়। তখন সাংবাদিকরা এ ব্যাপারে প্রশ্ন করলে এই ভাঁওতাবাজ নোবেল ধারী উত্তর দিয়েছিলেন, “আমি বলেছিলাম ঐ সামরিক ঘাটি বন্ধ করা হবে, সেটা বন্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু আমি তো এ কথা বলিনি গুয়ান্তানামো বে র সামরিক ঘাটি চিরতরে বন্ধ করা হবে।” এটা তো বড় ধরনের বাটপারি। বাংলাদেশের এক সুদখোর, বাটপার অবৈধভাবে ক্ষমতায় থেকে নোবেল হাতিয়ে নিয়েছে। জন এফ. কেনেডি, মহাত্মা গান্ধী, ইন্দিরা গান্ধী, বঙ্গবন্ধু এঁরা কেউ নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত না তাই বলে কি তাঁদের মহিমা এতটুকু অনুজ্জ্বল হয়েছে, না অবশ্যই না।
নৈতিকভাবে একজন রাজনীতিবিদের নোবেল গ্রহণ করা উচিত না। কারণ আলফ্রেড নোবেলের নির্দেশনা ছিল, “যে অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সমাজে শান্তির জন্য ভূমিকা রাখবে তাঁকে এই পুরস্কারে ভূষিত করতে হবে।” আমাদের প্রধানমন্ত্রী নোবেল ছাড়ায় শ্ব-মহিমায় উজ্জ্বল উনার এসব পুরষ্কার এত জরুরী না। এ জাতীয় পুরষ্কার উনার স্বাভাবিক কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করবে।
রোহিঙ্গাদের নিয়ে বি.এন.পি. র বিশেষ গাত্রদাহ লক্ষ করা গেছে। জার্মানিতে যখন সিরিয়ানদের ঢল নেমেছিল তখন অনেক তারকা ব্যক্তিরা নিজের বাড়িতে ৩/৪ জন করে তাঁদের আশ্রয় দিয়েছেন। বি.এন.পি. র নেতারা গলাবাজি না করে সেটা করলেই তো পারে তাতে অনেক সমস্যার সমাধান হবে। বি.এন.পি. নেতারা সরকারকে এই সমস্যা সমাধানে চীন ও ইন্ডিয়ার সাহায্য নিতে বলেছে। চীন কারো বন্ধু না এরা বোঝে ব্যবসা, শুধু নিজস্ব স্বার্থ এর বেশী/কম না। মানবতা বা মানবিকতা এদের মধ্য নেই। যদি তাদের স্বার্থে আঘাত লাগার কোন সম্ভাবনা থাকে তাহলে মানবতার বিরুদ্ধে যত আঘাতই আসুক না কেন তারা কোন কথা বলবে না। চীন বার্মার সাথে বাংলাদেশের চাইতে বেশী ব্যবসা করে অতএব চীনের সাহায্য চেয়ে ভাল কোন ফল হবে বলে মনে হয় না। চীন নিজেকে সাম্যবাদী দেশ হিসাবে দাবি করে কিন্তু পাকিস্তানের মত মৌলবাদী, সন্ত্রাসী রাষ্ট্র তাদের সবথেকে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এটা হিসাবে মেলে না। যদি ইন্ডিয়ার সাথে চীনের সীমান্ত বিরোধ না থাকত সে ক্ষেত্রে পাকিস্তান এ সুযোগ পেত কিনা সন্দেহ আছে। পাকিস্তান ইন্ডিয়ার বড় শত্রু অতএব শত্রুর শত্রু বন্ধু। তাই পাকিস্তান চীনের বড় বন্ধু এখানে নীতি আদর্শের কোন বালাই নেই। অন্তত চীন নামক দেশটি সেটা নিয়ে চিন্তা করে না। সোজা কথা যেখানে স্বার্থের প্রশ্ন আছে সেখানে উত্তর কোরিয়া বা মিয়ানমারে যত মানবাধিকার লঙ্ঘিত হোক না কেন চীন অতীতের ন্যায় নিশ্চুপই থাকবে।
ইন্ডিয়াও নিজস্ব স্বার্থের কারণে বেশী কিছু বলবে না। ইতিমধ্যে বিজেপি সরকার মুসলিম শরণার্থীদের জন্য আশ্রয় নিষিদ্ধ করেছে। ইন্ডিয়ারও মিয়ানমারের সাথে ব্যবসা বাণিজ্যের ব্যাপার আছে। তাছাড়া কৌশলগত আরও কিছু ব্যাপার আছে। চীন এক চেটিয়া ব্যবসা করছে সেখানে, সে বাজারে প্রতিবেশী দেশ হিসাবে ইন্ডিয়ারও প্রবল আগ্রহ আছে। তারাও মিয়ানমারকে চটাতে চাইবে না।
বাংলাদেশের উচিত সকল রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য ইন্ডিয়ার সীমান্ত ঘেঁসে আশ্রয় শিবির তৈরি করা। আর সীমান্তের বাংলাদেশের অংশ খুলে দেওয়া, যাতে রোহিঙ্গারা ইন্ডিয়ার মধ্যে ঢোকে। ঝাঁকে ঝাঁকে যখন ঢুকবে তখন বিএসএফ গুলি চালাতে সাহস করবে না। একা ফেলানিকে গুলি করা যত সহজ এখানে সেটা হবে না। ইন্ডিয়া ঠেলায় পড়লে তখন চাপ সৃষ্টি করবে। আর যদি ইন্ডিয়া গুলি চালায় তখন বাংলাদেশও সীমান্ত বন্ধ করে দেবার নৈতিক সমর্থন পাবে।
বার্মা দেশ হিসাবে বাংলাদেশের চেয়ে বড়, তাদের সামরিক শক্তি আমাদের ৪/৫ গুন এ কারণে বাংলাদেশ কোন কঠিন পদক্ষেপ নিতেও সাহস করবে না। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী মাঝে মাঝে ফ্ল্যাগ মিটিং করবে এর বেশি না। এই সামরিক বাহিনীকে সেনানিবাসে বসিয়ে খাওয়ানোর কি কোন মানে আছে বছরের সর্বোচ্চ ব্যয় বরাদ্দ করে তাদের পিছনে। এই জন্যই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন জনগণের সেনাবাহিনী (People’s Army) র কথা। আমাদের দেশের জন্য তো আধাসামরিক বাহিনীই যথেষ্ট। সারাদিন জাতীর পিতা, জাতীর পিতা করে মুখ দিয়ে থুথু তুলছি আমরা কিন্তু উনার নির্দেশিত পথে হাঁটছি না।
আমি মনে করি নোবেল চুলোয় যাক, আমাদের প্রধান মন্ত্রীর এই মূহুর্তে একটু কঠিন হওয়া জরুরী। সীমান্ত সাময়িকভাবে পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া। এরপর যদি ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বা কেউ কিছু বলে, তাদের সাথে দরকষাকষি করা। আগে আর্থিক সাহায্য নিশ্চিত কর। সাহায্য পাঠাও, সাহায্য পৌঁছালে আমারা বেঁছে, বেঁছে শিশু, বৃদ্ধ ও মহিলাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ঢুকতে দেব। আর এসব মানুষকে বিনা পাসপোর্টে বিমানে তুলে দেব কোটা অনুযায়ী। এবং এই বিমানের ভাড়াও ওই সব দেশকে বহন করতে হবে। অন্যথায় সীমান্ত বন্ধ থাকবে চিরতরে। এটা মিয়ানমারের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার আমরা একা এর দায়িত্ব নিতে পারি না।
এরপর জাতিসংঘ যদি মনে করে মিয়ানমারে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে সেক্ষেত্রে জাতিসংঘের বাহিনী পাঠাতে পারে। যেমন পারমানবিক বোমার মিথ্যা অজুহাতে ইরাকে জাতিসংঘের বাহিনীকে পাঠানো হয়েছিল। আর মিয়ানমারে যা হচ্ছে তা তো মিথ্যা না। নোবেল ডাইনির গুণ্ডাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের উলঙ্গ বহিঃপ্রকাশ।
আর যেসব ভাইয়েরা নোবেল মাদকে আসক্ত তাদের বলি আমাদের নেত্রী স্ব-মহিমায় উজ্জ্বল উনাকে একটা নোবেল দিয়ে বা না দিয়ে, খাট বা বড় করা যাবেনা। অন্তত শেখ হাসিনার যোগ্যতার মাপকাঠি নোবেল পুরষ্কার না।
জয় বাংলা
জয় বঙ্গবন্ধু

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

লেখকের আরো কিছু পোস্ট